সেই সিন্ডিকেটের কবলেই বাজার, দ্রব্যমূল্যে দিশাহারা
- আপডেট সময় : ০৮:৫২:০০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৯ অক্টোবর ২০২৪
- / ৭৭১৭ বার পড়া হয়েছে
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরও গত দুই মাসে সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে দ্রব্যমূল্য। পণ্যের দাম মানুষকে স্বস্তি দিতে পারেনি। বরং স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্ট বাড়িয়েছে। বিগত সরকারের আমলের সেই সিন্ডিকেট ভাঙার কোনো আলামতও মেলেনি এখনো। এরই মধ্যে ডিম-মুরগির সিন্ডিকেটের বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে। সরকারের অগ্রাধিকারে থাকলেও বাজারব্যবস্থায় এখনো নিয়ন্ত্রণ আসেনি।
বাজারের তথ্য বলছে, গত দুই মাসে ডিম, মুরগি, সবজি, কাঁচামরিচ, ভোজ্যতেল, চিনিসহ বেশ কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি অস্থিতিশীল ডিম ও কাঁচামরিচের দাম। দু-একটি পণ্যের দাম কমেছে অতি সামান্য। এছাড়া প্রধান খাদ্যশস্য চালের যে চড়া দাম ছিল, সেটাও বরং আরও একটু বেড়েছে।
সোহেলী বেগম নামে একজন স্বল্প আয়ের মানুষ জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রত্যাশা ছিল নতুন সরকার দাম নিয়ন্ত্রণে ভালো পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু নানা খাতে সংস্কার হলেও দ্রব্যমূল্য কমিয়ে স্বস্তি দিতে পারেনি। যে কারণে আমাদের মতো কম আয়ের মানুষ এখনো কষ্টে আছে।
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা হয়েছে, এটা পণ্যমূল্যে একটি বড় প্রভাব ফেলছে সত্য। আবার এর মধ্যে কিছুদিন ব্যাংক দেনদেনের একটি লিমিট ছিল, ব্যবসায়ীরা ঠিকমতো এলসি খুলতে পারেননি। এসব কারণে বাজারে সরবরাহ বাড়ানো যাচ্ছে না।- অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রায় দুই মাসে পাঁচটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। কমেছে মাত্র দুটির। বেড়েছে তেল, চিনি, ডিম, মুরগি ও চালের দাম। কমেছে পেঁয়াজ ও আলুর।
টিসিবির বাজারদরের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ৮ আগস্টের তুলনায় গত রোববার মোটা চাল কেজিতে ১ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল লিটারে ৬ টাকা, চিনি ৩ টাকা, ডিম হালিতে ৮ টাকা, ব্রয়লার মুরগিতে ২০ টাকা বেড়েছে। আর পেঁয়াজ ও আলুর দাম কেজিতে কমেছে ৫ টাকা।
এসময় বেশ কিছু সবজি ও কাঁচামরিচের দাম বেশি ছিল, তবে এসব পণ্য টিসিবির হিসাবে নেই। পাশাপাশি এসময় ভরা মৌসুমে চড়া দামে বিক্রি হয়েছে ইলিশ মাছ। সেটাও সাধারণ মানুষের বড় উষ্মার কারণ।
দ্রব্যমূল্যের এ ঊর্ধ্বগতির কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বন্যাকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, এসময় রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের নানান প্রভাব পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় পড়েছে। যার কারণে সাধারণ মানুষ সুফল পায়নি।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজারে পণ্যের দাম বাড়া-কমার কিছু যৌক্তিক ও অযৌক্তিক কারণ আছে। এর মধ্যে সুদের হারে লাগাম তুলে নেওয়ায় বাজারে টাকার সরবরাহ কমে পণ্যের চাহিদা কমছে। এতে মূল্যস্ফীতি কমার সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে। আবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাজারে টাকার সরবরাহের ওপর নিত্যপণ্যের সব পণ্যের চাহিদা, জোগান ও দাম ততটা নির্ভর করে না। এসব পণ্যের দাম কমাতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ দরকার।
তারা বলছেন, বিগত দুই মাসে তেমন কোনো উদ্যোগ নজরে আসেনি। এছাড়া নিত্যপণ্যের বাজারে ব্যবসায়ীদের মনোপলি ব্যবসার প্রবণতা বেশি। বিগত সরকারের আমলে দীর্ঘদিন সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে অনেক ব্যবসায়ী অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যে কারণে নিত্যপণ্যের বাজার ও সরবরাহ ব্যবস্থায় সংস্কার দরকার।
পণ্যের দাম কমাতে পেঁয়াজ ও আলুর শুল্ক প্রত্যাহার করেছিল এ সরকার। যার দীর্ঘদিন পেরিয়ে পেঁয়াজের দাম সামান্য কমেছে এখন। যদিও এ সরকারের শুল্ক প্রত্যাহার ও এর মধ্যে ভারতের শুল্ক কমানোর তুলনায় সেটা খুব নগণ্য।
বেশ চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন সবজি। এখন পেঁপে ছাড়া অন্য কোনো সবজি ৬০ টাকার নিচে মিলছে না। এছাড়া কাঁচামরিচের দাম প্রায় ওঠানামা করছে। একদিন ২০০ টাকা কেজি বিক্রি হলে পরদিন ৩০০ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে চারশ টাকায়।
যদিও বিক্রেতারা বলছেন, টানা কয়েকদিন বৃষ্টির কারণে সবজির সরবরাহ কমেছে। অনেক সবজি ক্ষেতে নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া এখন গ্রীষ্ম মৌসুমের সবজিগুলোর সরবরাহ শেষ দিকে, আর শীত মৌসুমের আগাম সবজির সরবরাহ কম। দুই মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে এখন দাম বাড়ছে।
এখন বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। ব্যবসায়ীদের যে উচ্চ মুনাফার প্রবণতা সেটা থেকে বের করে আনতে হবে। পাশাপাশি ডলার সংকট কাটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যবসায়ীদের জন্যও সুষ্ঠু পরিবেশ প্রয়োজন।- অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন
রামপুরা বাজারের সবজি বিক্রেতা আজাহার আলী বলেন, ‘গ্রীষ্ম মৌসুম শেষ, শীত মৌসুম শুরুর আগের এই সময়টি প্রতিবছর সবজির দাম একটু বেশিই থাকে। এছাড়া বৈরী আবহাওয়ার কারণে সবজির সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। প্রত্যন্ত এলাকার মোকামগুলোতে এখন সবজির দাম বেশি।’
আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময় চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেলেও নতুন সরকার আসার পরে ঢাকার বাজারে চালের দামে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বরং মোটা চালের দাম আরও এক টাকা কেজিতে বেড়েছে এর মধ্যে।
বন্যার কারণেও বেড়েছে দাম
দেশের দক্ষিণের ১১ জেলায় আগস্টের বন্যা অন্তত ১৪ হাজার ৪২১ কোটি টাকার ক্ষতি করে দিয়ে গেছে বলে ধারণা দিয়েছে সিপিডি। বেসরকারি এ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, ক্ষতির ওই অংক ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১ দশমিক ৮১ শতাংশ।
বন্যায় কৃষি ও বন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই দুই খাতে ক্ষতির পরিমাণ ৫ হাজার ১৬৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এটি মোট ক্ষতির ৩৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ। যার একটি বড় প্রভাব বাজারে কৃষিপণ্যের দামে পড়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান জাগো নিউজ বলেন, ‘সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা হয়েছে, এটা পণ্যমূল্যে একটি বড় প্রভাব ফেলছে সত্য। আবার এর মধ্যে কিছুদিন ব্যাংক দেনদেনের একটি লিমিট ছিল, ব্যবসায়ীরা ঠিকমতো এলসি খুলতে পারেননি। এসব কারণে বাজারে সরবরাহ বাড়ানো যাচ্ছে না।’
তবে তিনি এ-ও বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে যে পরিমাণ সমস্যা হচ্ছে, পাশাপাশি কিছু সুবিধাও রয়েছে। আগের মতো চাঁদা ও অন্যান্য খরচ এখন নেই। তবে সে সুফল ভোক্তারা পাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা আগের মতো সিন্ডিকেট করে সংকটের সুযোগ নিয়ে দাম বাড়াচ্ছে।’
ডিমে আবার ‘সিন্ডিকেট’
সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ডিম ও মুরগির দাম বেঁধে দিয়েছে, এ দুটি পণ্যের ক্ষেত্রে সরকারের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ ছিল। শুল্ক কমিয়ে আমদানির ব্যবস্থা করে বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে বেঁধে দেওয়া দামে কিনতে পারেননি ভোক্তারা।
সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে মুরগিও বাড়তি দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে এখনো। রাজধানীতে ব্রয়লার মুরগি কেজি ১৯০ থেকে ২০০ টাকা এবং সোনালি মুরগি ২৭০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু ব্রয়লার মুরগির নির্ধারিত দর প্রতি কেজি ১৭৯ টাকা ৫৯ পয়সা এবং সোনালি মুরগি ২৬৯ টাকা ৬৪ পয়সা। এছাড়া এ সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ভারত থেকে ডিম আমদানি শুরু করেছে। তাতেও নামছে না দাম।
এই মুহূর্তে বাজারে সবচেয়ে অস্থিতিশীল পণ্য ডিমের দাম নিয়ে সিন্ডিকেটের বড় অভিযোগ এসেছে। প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) বলেছে, ডিম ও মুরগির বাচ্চার দাম বাড়িয়ে গত ২০ দিনে প্রায় ২৮০ কোটি টাকা লুট করেছেন করপোরেট ব্যবসায়ীরা।
সংস্থাটি বলেছে, মূল্যবৃদ্ধিতে করপোরেট গ্রুপ ও তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ীদের আধিপত্য বিস্তারের কারণে ডিম এবং মুরগির বাজারে অস্থিরতা। এই চক্র বারবার বাজারে কারসাজি করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে নিলেও তাদের শাস্তি হচ্ছে না। এ কারণে বাজারে অস্থিরতা বেড়েই চলছে বলে দাবি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, করপোরেট উৎপাদক পর্যায়ে প্রতিটি ডিম ১১ দশমিক ১ টাকায় বিক্রির কথা স্বীকার করলেও তারা প্রতারণার মাধ্যমে প্রতিটি ডিম বিক্রি করেছে ১১ দশমিক ৮০ থেকে ১২ দশমিক ৫০ টাকায়। ফলে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ টাকায়। এতে গত ২০ দিনে ১৬০ কোটি টাকা ভোক্তাদের পকেট থেকে তারা হাতিয়ে নিয়েছে।
একই সঙ্গে প্রতিটি ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দাম ছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে একই ব্রয়লার বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫৬ টাকায়। লেয়ার বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকায়। প্রতিদিন ৩০ লাখ সব ধরনের মুরগির বাচ্চা উৎপাদন হয়। প্রতিটি বাচ্চায় যদি ২০ টাকা বেশি ধরা হয়, তাহলে প্রতিদিন ছয় কোটি টাকা হয়। গত ২০ দিনে প্রান্তিক খামারিদের সঙ্গে প্রতারণা করে ১২০ কোটি টাকা কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত মুনাফা করেছে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার
৫ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয়েও আলোচনা করেছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল। তাদের সেই উদ্বেগের পর সরকারের তরফে বলা হয়েছে, পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণও তাদের অগ্রাধিকারে আছে।
সংলাপের পর বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছি। পুরোনো ‘সিন্ডিকেট’ আবার যে নতুন চেহারায় আবির্ভূত হয়েছে, সেটা নিয়ে আমরা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছি।’
তখন আমাদের জানানো হয়েছে, সরকার চারটা কাজকে অগ্রাধিকারে নিয়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণও তাদের অগ্রাধিকার। আমরা দেখতে চাই, মানুষ যেন এর সুফল পায়।
ওইদিন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম থেকেই সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করছে। ধীরে ধীরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগের অবস্থানে ফিরে আসছে। আশা করি খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
টাস্কফোর্স গঠন
শুল্কছাড় ও আমদানি উন্মুক্তের মতো কিছু সুবিধা দিলেও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে বাজারে এর কোনো প্রভাব না পড়ায় দু’মাস পরে বাজার মনিটরিংয়ে প্রতি জেলায় বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রতিটি জেলায় দশজন সদস্যের টাক্সফোর্স গঠন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যারা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর বাজার পরিস্থিতি ও সরবরাহ চেইন তদারক করবেন।
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। ব্যবসায়ীদের যে উচ্চ মুনাফার প্রবণতা সেটা থেকে বের করে আনতে হবে। পাশাপাশি ডলার সংকট কাটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যবসায়ীদের জন্যও সুষ্ঠু পরিবেশ প্রয়োজন।’